অনুসন্ধান (ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ৩১ আগস্ট, ২০১৪, ০২:১৮:২৫ দুপুর
১
আমি…
একজন লেখক।
মধ্য চল্লিশের অর্ধটেকো বেঢপ সাইজের একজন মানুষের জীবনের এই পর্যায়ে প্রেম আসবে কে ভেবেছিল! তিনি নিজেও কি এই মাসখানেক আগেও ভাবতে পেরেছিলেন? তাও আবার তিন বাচ্চার এক মায়ের সাথে। লেখক সাহেব নিজেও দুই বাচ্চার জনক। তারপরও...
২০ বছর এর সংসার জীবনে তাঁর কি এমন অপুর্ণতা ছিল যে নতুন করে হৃদয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হল? আসলে মানুষের মন এক অত্যধিক জটিল এবং ততোধিক সহজবোধ্য জিনিস। তবে এঁকে নিয়ন্ত্রণ করে সময়।
হ্যা সময়।
এই সময়ের প্রয়োজনেই ইদানিং আসাদ শিউলির সাথে পরকীয়ায় মজেছে। এখন নন্দন পার্কের অপজিটে চা এর দোকানে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
শিউলির আসার অপেক্ষায়।
একজন বুড়ো আর এক বুড়ির অপেক্ষায়!
নাহ! বুড়ি বলাটা কেমন যেন অতিরিক্ত র' হয়ে গেলো। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাই মানানসই হবে। চায়ের বিল মিটিয়ে মেইন গেট অভিমুখে রওয়ানা হল। আজ একটা সিগ্রেট খেতে ইচ্ছে করছে। যদিও রেখা ওকে এই বদভ্যাসটি অনেক আগে বহু সাধ্য-সাধনা করে 'রিমুভ' করিয়েছিল।
আজ সে তাঁর অর্ধাঙ্গীনীকে ছেড়ে অন্য কারো অর্ধাঙ্গীনির সাথে 'ডেটিং' এ এসেছে। আজ না হয় খেলোই একটা।
ঠিক এই মুহুর্তে রেখার কথা মনে পড়ে যাওয়াতে ভ্রুযুগল আসাদের কুঁচকে গেলো।
সাথে সাথে মনটা ও কি একটু তেতো হয়ে গেলো?
ধুস শালা বলে পায়ের কাছে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা 'এনার্জি ড্রিংকের' উপরে লাথি ঝারল। ধাতব আওয়াজ করে পাশে শুয়ে থাকা একটা কুকুরকে ভীতচকিত করে দৌড়ে পালাতে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই হল না। নিজের ভ্রু এবং মন যা ছিল তা-ই রয়ে গেলো।
তুমি…
নিজেকে মুটিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারছে না।
সারাদিনই তো কাজের ভিতরে থাকে। ঘুম-খাওয়া সবই পরিমিত। তারপরও...
অথচ রেখা ২০ বছর আগে যখন নতুন বউ হয়ে আসাদের জীবনে এসেছিল, পাটকাঠীর মত হাল্কা ও পল্কা ছিল। আসাদ তো ঠাট্টা করে বলত, 'ঝড়ের দিনে কখনো বাইরে থাকবে না, তোমায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন কিন্তু আমি খুঁজতে যেতে পারবনা... হাহহাহা...'। রেখা ওর সাথে হাসলেও ভিতরে ভিতরে কেমন যেন ম্রীয়মান হয়ে যেতো। আর সেই সময়গুলোতে একটু স্বাস্থ্যবতী হবার জন্য কতটা আশা নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকত... অন্যদেরকে দেখত। ওর সাথের বান্ধবীদের হাঁটার সময় গুরু নিতম্ব ও তাতে ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভাবে জাগিয়ে তোলা ঢেউ দেখে আক্ষরিক অর্থেই রেখার ভীষণ হিংসে হতো।
আর আজ?
নিজেই সর্বশরীরে নরম তুলতুলে মাংসের ভিতর বাহিরে অনিয়ন্ত্রিত ঢেউ আর ঢেউ!
তবে খুবই মায়াবতী চেহারা এখনো রেখার। দুধে আলতা রং।
হাসলে এখনো গালে টোল পড়ে যা দেখে অনেকেরই দম বন্ধ হয়ে আসে। আর গালে টোকা মারলে এখনো রক্ত জমে লাল হয়ে যায়। ওর মানুষটির অনেক আগের সেই কথাগুলো এখনো কানে বাজে, ' এমন মেয়েকে বিয়ে করতে হবে যে গালে টোকা মারলে রক্ত জমে যাবে'।
কত আগের বলা কথাগুলো... কিন্তু আজও কানে ভাসছে!
সেই গাল যদিও রয়ে গেছে কিন্তু টোকা মারার মানুষ থাকলেও টোকা মারার ইচ্ছেটা সেই মানুষটির নেই।
সে...
শিউলি বার বার মোবাইলের ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠা টাইম দেখছে। নন্দন পার্ক আসতে এখনো ঢের বাকি। এরই ভিতর কুড়ি মিনিট লেট হয়ে গেছে। আর পথে যে ট্রাফিক জ্যাম- তাতে নির্ঘাত আরো আধা ঘন্টা লাগবে ওর পৌঁছাতে। তারমানে আসাদের কাছে যখন সে পৌঁছাবে অলরেডি ঘন্টাখানেক দেরী হয়েই যাবে।
মনের ভিতর একাধারে দুষ্টুমি এবং মায়া-এই দুই এর মিশেলে এক বিষন্ন হাসি ঠোঁটের কোণে এসে জমে থাকে। বাসের মহিলা সীটে আরো তিনজন মহিলার পাশে বসে শিউলি ইউনিভার্সিটির সেই দিনগুলোতে ফিরে যায়...
তখনো আসাদকে ডেটিং এর দিনগুলোতে সে ইচ্ছে করেই দেরী করাত। ক্যাম্পাসের যে যায়গায় ওদের দেখা করার কথা - সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই শিউলি পৌঁছে যেত... তবে দূর থেকে লুকিয়ে আসাদকে দেখতো। অস্থির আসাদ... যে কিনা প্রতি মিনিটেই ওর আসার পথের দিকে অস্থির নয়নে চেয়ে চেয়ে নিস্ফল রাগে লাল হতো। আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ বেচারা সিগ্রেটের উপর ঝাড়ত। কষে টেনে টেনে ফিল্টারকে চুপষে ফেলত। আর একা একা পাগলের মত কি জানি বলত।
হ্যা, সে পাগলই ছিল।
শিউলির জন্য পাগল!
ও কাছে এলেই একেবারে নির্বিষ হয়ে যেতো আসাদ। শিউলির চোখের দিকে তাকালে এতোক্ষণের অপেক্ষার দুঃসহ প্রহরগুলির দেওয়া যন্ত্রণাসহ মিইয়ে যেতো।
আজও সে একই রকম রয়ে গেছে।
যদিও মাঝে কুড়ি বছর কেটে গেছে। যে কোনো কারণেই হোক ওরা সেই সময় এক হতে পারেনি। তবে আজ কুড়ি বছর পরে ওদের জীবন যখন ভিন্ন নারী ও পুরুষকে নিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে নিত্য অভ্যাসে অভ্যস্ত- তখনই ওরা আবার নিয়তির পরিহাসে কীভাবে যেন এক হল!
সব দিক দিয়েই।
আসলেও কি তাই?
হঠাৎ ব্রেক করাতে চিন্তার জাল ছিন্ন হয়।
জানালা দিয়ে নন্দন পার্কের গেইট দেখতে পায়।
শিউলির দুচোখ হন্যে হয়ে একজন আসাদকে খুঁজতে থাকে।
ভীষন মায়াভরা সে দুটি চোখে।
২.
‘বিকৃতির অপভ্রংশ স্তরের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে লোলচর্ম এক বৃদ্ধ শকুনের নখরে নিস্পেষিত এক মুষিক শাবকের নীল বেদনার স্বরূপ কি দর্শকের হৃদয়ে অনুভুত হয়... ...’ একা একা নন্দন পার্কের গেটে অপেক্ষারত আসাদের মাথায় এই লাইনটি হঠাৎ করে এসে গেলো। পকেটের ছোট্ট নোট বইতে সে লিখতে শুরু করে।
এই এক অসুবিধা আসাদের।
যে কোনো সময়েই মাথায় লেখার পোকারা কিলবিল করে।
এখন সে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। অনেকগুলো বই বাজারে বেরিয়েছে। বেশ ভালোই পাঠক সমাদৃত হয়েছে সেগুলো। একটি পত্রিকার সাথে জড়িত রয়েছে সে। সেই হিসাবে লেখালিখি ছাড়া সাংবাদিকতাকেই তাঁর মুল পেশা বলা যায়। লেখক সংঘের একজন সদস্য... আর একটি নির্দিস্ট রাজনৈতিক দলের তাত্ত্বিক নেতা হিসাবেও পর্দার আড়ালে তাঁর অবস্থান। সব মিলিয়ে মোটামুটি বেশ আছে।
লেখায় এতোটা মশগুল হয়ে ছিল যে, তাঁর সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে মোটেও টের পেলনা। তবে আলো সরে গিয়ে একটু ছায়ার কোমলতা একবার অনুভব করলেও সেদিকে নজর দেবার মতো অবস্থা ঠিক এই মুহুর্তে ছিল না। পরিচিত মেয়েলি হাসির শব্দে তাকাতে বাধ্য হল।
শিউলি।
হ্যা, শিউলিই সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রানের সাথে সাথে মনটা কেমন চনমনে হয়ে উঠে আসাদের। নোট বইটি পকেটে ঢুকিয়ে বল পেনের মুখা লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করে, ‘ কখন এলে?’
‘এই তো... যখন থেকে লেখা শুরু করেছ তখনি।‘
মনে মনে এবার একটু রাগ হল আসাদের। মেয়েদের এই এক স্বভাব। কখনো সোজা কথাটা সহজ করে বলতে পারে না।
বলতে পারে না নাকি বলতে চায় না?
এই যে সে কি সুন্দর একটা ভাবের ভিতরে ছিল ... শিউলির শেষের এই মিথ্যে উত্তরটা মনে মনে কেমন ওকে রাগিয়ে দিল। হ্যা, সে মিথ্যেই তো বলেছে। কারণ ও এইমাত্রই এসেছে। আর বলল কিনা ‘ওর লেখার শুরুতে এসেছে’। তবে কি মেয়েরা ছেলেদের সাথে ইচ্ছে করেই এমনটা করে? যাতে করে মন খারাপ অবস্থা থেকে ছেলেরা ওদের সান্নিধ্যে মনটাকে আবার ভালো করতে পারে?
এটা তবে ওদের পুরুষদের নিয়ে এক ধরণের এক্সপেরিমেন্ট...
‘কি হল? কোথায় তুমি? অবাক শিউলি জিজ্ঞেস করল।
‘ কিছু না। চল ভিতরে যাই।‘
মুখের হাসিটা একটু ম্লান হয়ে গেলো শিউলির। তবে জোর করে সেটাকে ধরে রাখার চেষ্টা না করে আসাদের সাথে টিকেট কাউন্টারের দিকে আগাতে থাকে। আর এই মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করে। বছর কুড়ি আগের সেই সুদর্শন আসাদের সাথে আজকের এই মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে মেলাতে চেষ্টা করে। বাহ্যিক পরিবর্তনের সাথে সাথে কি কোনো মানুষের মনেরও পরিবর্তন হয়ে যায়? সময় তবে সব কিছুর সাথে সাথে মনকেও তাহলে বদলায়। না হলে যে আসাদকে সে চিনত, সে ছিল উচ্ছল- পুর্ণ যৌবন এর নদীর ঢেউয়ের মত। যে ঢেউয়ের আগ্রাসনে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। সব কিছু সঁপে দিয়েছিল সেই নদীতে। কিন্তু নদী তাকে গ্রহন না করে নিরাসক্তের মত তীরে ছুড়ে দিয়েছিল।
গ্রহন না বলে ভোগ করেনি বললেই ভাল হয়। তবে করার মত সব পরিবেশই শিউলি তৈরী করেছিল। জীবন নামের এই রঙ্গমঞ্চে নিয়তির এক কালবৈশাখী এসে শিউলিকে ওর ‘নিজের অতি আপন সেই নদী’ থেকে অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তটরেখা ধরে সেই চিরচেনা পুরনো যায়গাটিতে আসতে ওর বিশটি বছর লেগে গেলো।
কেন সে ফিরে এলো?
কিসের শুন্যতাকে পুরণ করতে চায় সে? জীবন তো তাকে সব কিছুই দিয়েছে... দু’হাত ভরে দিয়েছে। এই ভাবনাটা আসাতে নিজেকে একবার মনের ভিতরের আয়নায় দেখে শিউলি।
নাহ! জীবন তাকে সব কিছু দিলেও তাঁর ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। যা সে আজও পায়নি।
তবে কি টাক মাথার এই প্রায় বিগত যৌবনা মানুষটির কাছে ওর ভালবাসা রয়ে গেছে? এজন্য কি সে গত এক মাস ধরে ওকে কেন্দ্র করে ওর পরিচিত জীবনের রুটিনকে অবহেলা করে ঘুরপাক খাচ্ছে? মানুষটি কি সেটা বুঝতে পারছে?
পার্কের ভিতরে প্রবেশ করে একটু অপেক্ষাকৃত নির্জন কোণ খুঁজতে থাকে শিউলি। আজ অনেক কিছু জানার আছে ওর আসাদের কাছ থেকে। এতো ভীড়ের ভিতরে সেটা আলাপ করা যাবে না। ওদের আশে পাশে কত ছেলে মেয়ে তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা উচ্ছাসে মাতোয়ারা- রঙিন জীবনের রুপ-রস-ঘ্রাণ সবকিছুকে এক লহমায় যেন পেয়ে যেতে চায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস মনের অজান্তেই বেরিয়ে এলো।
একটু চমকে আসাদের দিকে তাকায়।
ওকি কিছু বুঝতে পারল?
গত কুড়ি বছরে শিউলির হৃদয় থেকে এমন কত হাজারো হৃদয় পোড়ানো জ্বলন্ত বাতাস বের হয়েছে, আসাদ কেন অন্য কেউ কি তাঁর খবর রেখেছে!!
বিষয়: সাহিত্য
১১৪০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনাকেও ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা রইলো।
আপনিও ভালো থাকুন।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন